"তোফাজ্জ্বলকে কেন মেরে ফেলতে হবে?"
—এই প্রশ্নটা শুধু একটি ঘটনার নয়, পুরো সমাজের মনস্তত্ত্বের প্রতিফলন। তোফাজ্জল প্রতিআঘাত করেনি, এমনকি সে নিরস্ত্র ছিল। নিরস্ত্র, আঘাতহীন একজন মানুষকে মেরে ফেলার যৌক্তিকতা কোথায়? এটা তো এমন এক নিষ্ঠুরতা, যেখানে মানবিকতার সব নীতি ভেঙে গেছে।
যদি ঘটনাটি কোনো সাধারণ স্থান যেমন বাস স্টেশন বা বাজারে ঘটতো, হয়তো সেটাকে আরও সহজে বোঝা যেত। সেখানে বিভিন্ন ধরনের মানুষ থাকে, কখনো কারো ব্যক্তিগত ক্ষোভ বা সামান্য সন্দেহ থেকে উত্তেজনা সৃষ্টি হতে পারে। কিন্তু এই ঘটনার প্রেক্ষাপট যে আরও গভীর এবং হৃদয়বিদারক, তা এই কারণে যে ঘটনার সাথে যুক্ত সবাই ছাত্র। তার উপর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, যারা জাতির ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের অংশ হিসেবে বিবেচিত হয়।
পথে চলতে গিয়ে যদি কোনো কুকুরও কামড় বা ভয় না দেখায়, তাহলে কি কেউ সেই কুকুরকে আঘাত করে? তেমনি, তোফাজ্জল একজন জ্যান্ত মানুষ, যে কারও জন্য বিপদ ছিল না। তাহলে শুধুমাত্র সন্দেহের বশে তাকে মেরে ফেলা কেন?
ধরা যাক, তোফাজ্জল সত্যিই কোনো অপরাধ করেছে—চুরি করেছে, তা-ও লক্ষ টাকার মূল্যবান কিছু !!!!
তারপরও প্রশ্ন থাকে, চুরির শাস্তি কি মৃত্যুদণ্ড হতে পারে? আমাদের আইনের শাসন আছে, বিচারব্যবস্থা আছে। সেখানে তার বিচার হতো, কিন্তু তা না করে মানুষ নিজেদের হাতে আইন তুলে নিচ্ছে।
আমরা আসলে কীসের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি? আমাদের সমাজে কি এতটাই হিংস্রতা বাসা বেঁধেছে যে কারও প্রাণ নিয়ে খেলা আমাদের কাছে সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে?
আমাদের মানসিকতায় যে বিকৃতি ঘটেছে, তা ভয়াবহ। আমরা যেন সহিংসতায় মজা পাই, অন্যের কষ্টকে উপভোগ করি। সামাজিক মিডিয়া, টিভি শো, সিনেমা—সব জায়গায় সহিংসতার চিত্র দেখে দেখে আমরা নিজেরাই সহিংস হয়ে উঠছি। আমরা ভুলে যাচ্ছি যে, প্রতিটি জীবনের মূল্য আছে, প্রতিটি মানুষই সমানভাবে বিচার পাওয়ার যোগ্য।
মৃত্যুর পর তোফাজ্জল সম্পর্কে যতই জানছি, ততই আমার মন আরও অস্থির হয়ে উঠছে।
আহারে!
সেতো কারও সন্তান ছিল, কারও ভাই, কারও আপনজন। একজন জীবন্ত মানুষ, যার জীবন ছিল নিজের লড়াইয়ের মাঝে, যার আশা-আকাঙ্ক্ষা ছিল, এখন সে আর নেই। তাকে হারানোর বেদনা শুধু একজন মানুষকে হারানোর নয়, বরং একটা গোটা মানবিকতার হারিয়ে যাওয়ার কষ্ট।
তোফাজ্জল যে মানসিক ভারসাম্যহীন ছিল, তা শুনে হৃদয় আরও ভারী হয়ে গেল। তার জীবনের কাহিনী শুনলে যে কেউ স্তব্ধ হয়ে যাবে। অনেকদিন আগেই মা-বাবাকে হারিয়েছে। জীবনের শেষ আশ্রয় বড় ভাইয়ের মৃত্যুর পর সে একেবারে নিঃস্ব হয়ে পড়েছিল। সেই শূন্যতা এবং হারানোর কষ্ট তোফাজ্জলকে আরও দুর্বল করে তুলেছিল, তার মানসিক ভারসাম্যহীনতার শেকড়টা সেখান থেকেই গাঁথা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রতিষ্ঠানের ছাত্রদের মধ্যে এমন নৃশংস আচরণ কেবল হতাশারই নয়, বরং ভাবনারও বিষয়। এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তো মননশীলতার, জ্ঞানার্জনের, মানবিকতার জায়গা। এই ছাত্ররা তো আমাদের ভবিষ্যৎ সমাজের চালিকা শক্তি। তারা যদি অন্যায়ের প্রতিবাদ না করে, বরং নিজেরাই অন্যায়ের অংশ হয়ে যায়, তাহলে আমরা কোন পথে যাচ্ছি?
অন্যের মৃত্যুতে আনন্দ পাওয়া বা সেটাকে তুচ্ছজ্ঞান করা আমাদের মানবিকতাকে গ্রাস করছে। হিংস্রতা আমাদের হৃদয়ে এমনভাবে জায়গা করে নিচ্ছে যে আমরা দিন দিন নিজেরাই নিজের অজান্তে মানসিক বিকৃতিতে পরিণত হচ্ছি। আমাদের এই মনস্তাত্ত্বিক অবস্থা বদলাতে হবে। সমাজের প্রতিটি মানুষকে সচেতন হতে হবে, শিক্ষা আর নৈতিকতার মাধ্যমে আমাদের এই হিংস্রতা থেকে মুক্তি পেতে হবে।
কিছুদিন আগেও যে ছাত্ররা আমাদের নতুন একটি দেশ উপহার দিয়েছিল, সেই ছাত্রদের নিয়ে আমরা গর্ব করেছি। তাদের ত্যাগ, বুদ্ধিমত্তা, সাহস আর দেশপ্রেম আমাদেরকে স্বাধীনতার আলোয় উদ্ভাসিত করেছে। ছাত্ররা যেমন নির্ভীকভাবে দেশের জন্য জীবন দিয়েছে, তাদের রক্তের দাগ এখনো মুছেনি Iতেমনি পরবর্তী সময়েও দেশের পুনর্গঠন তাদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। কিন্তু এখন যখন দেখি, সেই ছাত্রসমাজের কিছু অংশ অপরাধে লিপ্ত
এই পরিস্থিতি শুধু হতাশার নয়, বরং অত্যন্ত বিপজ্জনকও। শিক্ষিত যুবসমাজ যখন বিপথে চলে যায়, তখন একটি জাতির ভবিষ্যৎই ঝুঁকির মধ্যে পড়ে। আজকের ছাত্ররা যদি অন্যায়ের পথকে বেছে নেয়, তাহলে আগামী দিনে সমাজ কেমন হবে? তারা যে মানুষ হওয়ার, নেতৃত্ব দেওয়ার, সমাজকে এগিয়ে নেওয়ার আশা ছিল, সেটি যেন ক্রমশ ফিকে হয়ে যাচ্ছে।
আমরা এই সমস্যার গভীরে যদি তাকাই, তাহলে দেখতে পাই, ছাত্রদের এই অপরাধে জড়িয়ে পড়ার পেছনে রয়েছে সামাজিক অবক্ষয়, নৈতিক শিক্ষার অভাব, এবং সমাজের ব্যর্থ নেতৃত্ব। যখন সৎ, নৈতিক নেতৃত্বের সংকট তৈরি হয়, তখনই তরুণ প্রজন্ম বিভ্রান্ত হয়। তারা ভুলপথে পা বাড়ায়, সমাজের মূল্যবোধকে ভেঙে ফেলে।
তবে এই হতাশার মাঝে আশা আছে। আমরা যদি সঠিকভাবে শিক্ষার মাধ্যমে নৈতিকতা, মানবিকতা, এবং দেশপ্রেমের বীজ ছাত্রদের মধ্যে বপন করতে পারি, তবে তারা আবারও সমাজের আদর্শ হয়ে উঠবে। কিন্তু এর জন্য আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা, পারিবারিক পরিবেশ, এবং সামাজিক মূল্যবোধের পুনর্গঠন প্রয়োজন।
0 Comments