তানিয়া আর ফয়সালের প্রেমের
গল্পটা শুরু হয়েছিল কলেজের গেটের সামনে। তানিয়ার হাসিটা ছিল ঠিক ফুলের মতো, মিষ্টি আর মন ছোঁয়া।
ফয়সালের চোখে তখন শুধু তানিয়াকেই দেখা যেত, আর কারো জায়গা
ছিল না। প্রথম দেখাতেই মনটা বলে উঠেছিল, "এই মেয়েটাই আমার!"
তানিয়াও বুঝতে পারছিল ফয়সালের মনোভাব, কিন্তু সে সময় নিলো।
ধীরে ধীরে ওদের সম্পর্কটা গভীর হতে লাগলো। একে অপরের সাথে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফোনে
কথা, কলেজ শেষে গলির মোড়ে দেখা করা, সবকিছু যেন স্বপ্নের মতো লাগছিল।
তাদের ভালোবাসার গল্পটা এমনই ছিল, যেন কোন রূপকথার গল্প। তবে সুখের মতোই দুঃখও জীবনের অঙ্গ। একদিন হঠাৎ করেই তানিয়ার পরিবার থেকে অন্য এক ছেলের সাথে
তার বিয়ের কথা উঠে। তানিয়া প্রথমে খুব বিরোধিতা করলেও, পরিবারের চাপ আর বাস্তবতার কারণে
শেষ পর্যন্ত তানিয়া বাধ্য হলো বিয়েতে রাজি হতে।
ফয়সাল জানলো এ খবর, আর
তার জগতটা যেন থমকে গেলো। সে কিছুতেই মেনে
নিতে পারছিল না। তানিয়াকে নিয়ে সে কত স্বপ্ন
দেখেছিল, আর এখন সবকিছু
ভেঙে চুরমার। তানিয়া ফয়সালকে বুঝাতে চেষ্টা করলো, কিন্তু তার চোখে ছিল অসীম বিষাদ।
বিয়ের দিন তানিয়া লাল বেনারসি পড়ে যখন মণ্ডপে বসেছিল, তার মনটা তখনও ফয়সালের কাছেই ছিল। ফয়সাল মণ্ডপের পাশে দাঁড়িয়ে ছিল, কিন্তু সামনে আসার সাহস হয়নি। তানিয়ার চোখের কোণে জমে থাকা অশ্রুগুলো শুধু ফয়সালই দেখেছিল।
তানিয়া যখন বিয়ের শেষ পর্বে সিঁদুর পড়ছিল, তখনও তার মনে ছিল ফয়সালের মুখ। ফয়সাল আর তানিয়া দুজনেই
জানতো, তাদের ভালোবাসা ছিল সত্যিকারের, কিন্তু বাস্তবতার সাথে তারা যুদ্ধ করে হার মানতে বাধ্য হয়েছিল।
তানিয়ার বিয়ে হয়েছে তিন মাস হলো, কিন্তু সে কখনও সুখী
হতে পারেনি। বিয়ের দিন থেকেই তার মনে ছিল ফয়সালের কথা, আর সেসব স্মৃতি
যেন তাকে প্রতিদিন তাড়া করে বেড়ায়। তানিয়ার স্বামী রাজীব ভালো মানুষ হলেও, তার মনে ফয়সালের জায়গা কেউ নিতে পারেনি।
প্রতিদিন তানিয়া নিজের মনের সাথে যুদ্ধ করে। রাজীবের সাথে হাসিমুখে কথা বলার চেষ্টা করে, সংসারের সব দায়িত্ব পালন
করে, কিন্তু হৃদয়ের গভীরে একটা বিশাল শূন্যতা বয়ে বেড়ায়। রাতের নির্জন সময়ে, যখন সবাই ঘুমিয়ে পড়ে, তানিয়া একা বসে ফয়সালের সাথে কাটানো সময়ের কথা মনে করে কাঁদে।
রাজীব তানিয়ার মাঝে কিছু একটা ভুল লক্ষ করে, কিন্তু সে বুঝতে পারে
না তানিয়ার মনের গভীরে কিসের কষ্ট। তানিয়া সবসময় চুপচাপ থাকে, হাসি মুখে কথা বললেও চোখের গভীরে থাকে বিষাদের ছায়া।
একদিন, রাজীব তাকে জিজ্ঞাসা করলো, "তুমি কি সুখী তানিয়া?"
তানিয়া কোনো উত্তর দিতে পারল না। সে শুধু চোখের
জল লুকানোর চেষ্টা করলো। রাজীব বুঝতে পারলো, তানিয়া কিছুই বলতে পারছে না, কারণ তার মন অন্য কোথাও
পড়ে আছে।
তানিয়ার জীবনটা যেন এক বন্দি পাখির
মতো হয়ে গেল। সে মুক্তি চায়,
সে সুখ চায়, কিন্তু সব কিছুই তার
হাতের বাইরে। ফয়সালের প্রতি তার ভালোবাসা আজও মনের গভীরে বাস করে, আর সেই ভালোবাসা
তাকে প্রতিদিন তাড়া করে।
তানিয়া জানে, এই জীবনে সে
হয়তো আর কোনোদিনই সুখী
হতে পারবে না। রাজীবের সাথে সংসার চালিয়ে যাবে, কিন্তু তার হৃদয়ের গভীরে সেই চিরন্তন দুঃখ বয়ে বেড়াবে।
তানিয়া আর পারছিল না।
তার মনের কষ্টগুলো একেকটা বোঝা হয়ে উঠছিল, যা সে আর
বইতে পারছিল না। রাজীবের সাথে কাটানো প্রতিটি দিন যেন তাকে আরও বেশি দূরে ঠেলে দিচ্ছিল, তার নিজের থেকে, তার ভালোবাসা থেকে।
একদিন, তানিয়া হঠাৎ করেই সব কিছু ছেড়ে
চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো। নিজের ব্যাগ গুছিয়ে, কাউকে কিছু না জানিয়ে, সে
রাজীবের ঘর ছেড়ে বেরিয়ে
গেল। মনে ছিল শুধুই ফয়সালের কথা।
ফয়সালের সাথে দেখা করার জন্য তানিয়া সেই পুরনো জায়গায় গেলো, যেখানে ওরা একসময় নিয়মিত দেখা করত। ফয়সাল তখনও তানিয়ার কথা ভুলতে পারেনি। তার জীবনও থেমে ছিল তানিয়াকে ভুলতে না পারার কারণে।
তানিয়া ফয়সালের সামনে এসে দাঁড়ালো, চোখে জল আর মুখে
গভীর যন্ত্রণার ছাপ। ফয়সাল তার চোখের দিকে তাকিয়ে সব কিছু বুঝতে
পারলো।
"ফয়সাল, আমি আর পারছি না,"
তানিয়া ধীরে ধীরে বলল। "আমি রাজীবকে ছেড়ে চলে এসেছি। আমি জানি, এভাবে চলে আসা ঠিক হয়নি, কিন্তু আমি আর ওই সংসারে
থাকতে পারছিলাম না। তুমি কিছু একটা করো, আমাদের জন্য।"
ফয়সাল কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলো। তানিয়ার দিকে তাকিয়ে সে বুঝতে পারছিল,
তানিয়া কতটা ভেঙে পড়েছে। কিন্তু তানিয়াকে ফয়সাল অনেক ভালোবাসলেও, বাস্তবতার কাছে সে হার মানতে
শিখেছে।
ফয়সাল ধীরে ধীরে বলল, "তানিয়া, আমি তোমাকে খুব ভালোবাসতাম, আর এখনও বাসি।
কিন্তু তুমি যখন আমাকে ছেড়ে চলে গেলে, আমার জগতটা ভেঙে গিয়েছিল। আমি নিজেকে অনেক কষ্টে সামলেছি, নিজের জীবনটাকে নতুন করে গড়ার চেষ্টা করেছি।"
তানিয়া ফয়সালের কথা শুনে হতবাক হয়ে গেল। সে ভেবেছিল, ফয়সাল
তাকে গ্রহণ করবে, তার পুরোনো ভালোবাসাকে আবার ফিরিয়ে নেবে। কিন্তু ফয়সালের কণ্ঠে ছিল দৃঢ়তা।
ফয়সাল আরও বলল, "তানিয়া, তুমি রাজীবের সাথে বিয়ে করেছো, তোমার সংসার আছে। আমি জানি, তুমি কষ্টে আছো, কিন্তু সেই কষ্টের সমাধান আমি হতে পারি না। তুমি আমার কাছে ফিরে এসেছো, কিন্তু আমি আর তোমাকে গ্রহণ
করতে পারবো না। আমাদের জীবনের সেই অধ্যায় শেষ হয়ে গেছে।"
তানিয়ার চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। সে বুঝতে পারছিল,
ফয়সাল আর সেই পুরোনো
ফয়সাল নেই। তার ভালোবাসা এখনও আছে, কিন্তু সেই ভালোবাসা বাস্তবতার সামনে দাঁড়িয়ে নিঃশব্দে বিদায় নিচ্ছে।
ফয়সাল তানিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল, "তুমি নিজের জীবনের সিদ্ধান্ত নিজেই নাও, কিন্তু আমি তোমার সাথে আর সেই পথটা
হাঁটতে পারবো না। আমাদের যা ছিল, তা
অতীত। তুমি তোমার নতুন জীবনে ফিরে যাও, সেখানে তোমার দায়িত্ব আছে, তোমার বাস্তবতা আছে।"
তানিয়া বুঝতে পারলো, ফয়সাল যা বলছে, সেটাই
ঠিক। সে আস্তে আস্তে
ফয়সালের কাছ থেকে সরে গেল, মনের মধ্যে এক বিশাল শূন্যতা
নিয়ে।
ফয়সাল চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল, তার চোখেও অশ্রু জমেছিল, কিন্তু সে জানতো, এটাই
সঠিক সিদ্ধান্ত।
0 Comments